তুলসী পাতার সকল ঔষধি গুনাগুন - তুলসীর বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা ও অপকারিতা
আজকে আমরা তুলসী পাতার সকল ঔষধি গুনাগুন এবং তুলসীর বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। তুলসী গাছ একটি ঔষধি গুনাগুন সম্পন্ন উদ্ভিদ। ভারত বাংলাদেশ সহ প্রায় সকল জায়গায় তুলসী দেখতে পাওয়া যায়। তুলসী গাছকে অক্সিজেনের ভান্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। হিন্দু ধর্মে তুলসী গাছকে দেবী রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। এটি ভারতের ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক রূপে চাষ করা হয়ে থাকে।
বিভিন্ন ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে তুলসী গাছ ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সর্দি কাশি সহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুস্থতার ঔষধ হিসেবে তুলসী পাতার রসের ভূমিকা অপরিসীম। তুলসী বিভিন্ন ধরনের হয়। উল্লেখযোগ্য কিছু তুলসী হল:- বাবুই তুলসী, রাম তুলসী, কৃষ্ণ তুলসী এবং শ্বেত তুলসী।
ভূমিকা
তুলসীর বৈজ্ঞানিক নাম হল ( Ocimum Sanctum)। এটি একটি চিরহরিৎ গুল্ম জাতীয়
উদ্ভিদ। সর্দি ও ঠান্ডার ফলে সৃষ্ট যেকোনো ধরনের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তুলসী
পাতার রস এবং মধুর মিশ্রণ অত্যন্ত কার্যকরী বলে গণ্য করা হয়। মানসিক চাপ দূর
করা, গলা ব্যথা ও সর্দি কাশি দূর করা সহ রোগ প্রতিরোধ করে। তুলসী পাতার সকল ঔষধি
গুনাগুন অপরিসীম।
তুলসী পাতার বৈশিষ্ট্য
- তুলসী গাছের পাতা খাজকাটা আকৃতির হয়ে থাকে।
- তুলসী পাতার সামনের অংশে পাঁচটি ফুল যুক্ত ডাল বের হয় এবং সেই ডালগুলোতে ১৫ বৃষ্টির স্তরে ফুল থাকে। সকল স্তরে সাধারণত ছয়টি করে ফুল ফুটে থাকে।
- তুলসী গাছের পাতা সাধারণত সবুজ বা বেগুনি রংয়ের হয়ে থাকে ।
- তুলসী গাছ প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে।তুলসীর পাতা সাধারণত দুই থেকে চার সেন্টিমিটার এর মতো লম্বা হয়ে থাকে।
- পাতায় এক ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধ বিদ্যমান রয়েছে। তুলসী পাতাতে বিদ্যমান রয়েছে ফ্ল্যাভোনয়েড এবং পলিফেনল। এ সকল যৌগ উপস্থিত থাকার কারণে তুলসী পাতা এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এর ব্যবহারে ক্ষতির হাট থেকে কোষ রক্ষা করা যায়।
- তুলসী পাতার বৈশিষ্ট্য হলো এটি শরীরের বিষাক্ত ক্ষতিকর পদার্থ ও রোগ জীবাণু দূর করতে সাহায্য করে এবং ইমিউনিটি বৃদ্ধি করে। এজন্য তুলসী পাতার সকল ঔষধি গুনাগুন অনেক বেশি।
তুলসী পাতার ঔষধি গুনাগুন
- রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে তুলসী গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তুলসী গাছের প্রতিটি অংশই রোগ সারাতে সাহায্য করে। তুলসী গাছের বীজ ও পাতাসহ বাকল-শেকড় সবকিছুই রোগ নিরাময় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
- ফুসফুসের দুর্বলতা দূর করার ক্ষেত্রে তুলসির পাতা অর্থাৎ তুলসীর পাতার রস ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
- সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট নিরাময়ের জন্য তুলসী পাতা এবং আদার রস একসাথে মধু দিয়ে মিশিয়ে খেতে হবে।
- খালি মুখে সকাল বেলা তুলসী পাতা চাপিয়ে রস সেবন করার মাধ্যমে মুখের রুচি বৃদ্ধি পায়।
- তুলসীর রস বা তুলসীর বিভিন্ন সিরাপ খাওয়ার মাধ্যমে সর্দি ও জ্বর ভালো হয়।
- গরম পানিতে তুলসীর রস মিশিয়ে গড়গড়া সহ কুলি করলে গলা ব্যথা এবং মুখের দুর্গন্ধ তা দূর হয়। এবং মুখের রোগ জীবাণু দূর হয়ে যায়।
- তুলসী পাতা সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে, সেই পানি দ্বারা মুখ ধুয়ে ফেললে চোখের সমস্যা দূর করতে সহায়তা হয়।
- তুলসী পাতার রস ওজন কমাতে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
তুলসী পাতার উপকারিতা
তুলসী পাতার সকল ঔষধি গুনাগুন অত্যধিক থাকার কারণে তুলসী পাতা আমাদের শরীরের
জন্য খুবই উপকারী। তুলসী পাতার উপকারিতা বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা। অনেকেই
জানে না তুলসী পাতার উপকারিতা সম্বন্ধে। তুলসী পাতা বিভিন্ন মারাত্মক রোগের
বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। হৃদরোগ, ক্যান্সার ও
ডায়াবেটিস সহ বিভিন্ন ধরনের রোগের ক্ষেত্রে তুলসী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং
অ্যান্ডি ইনফ্লেমেন্টারি হিসেবে রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে। আসুন জেনে
নেই তুলসী পাতার উপকারিতা সম্পর্কে।
- সর্দি-কাশি নিরাময়: সর্দি কাশি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি সাধারণ অসুখ। কিন্তু অতিরিক্ত সর্দি কাশি খুবই বিরক্তিকর। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটি মহা ঔষধ হলো তুলসীর রস। তুলসীর রসের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে সর্দি ও কাশি অতি দ্রুত সেরে যাই ।
- গলা ব্যথা দূর: অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পান করা বা অন্য কোন কারণে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ফলে বুকে কফ জমে যেতে পারে। বুকে কফ জমার ফলে প্রচন্ড গলা ব্যথা হলে, সেইটা নিরাময়ের জন্য তুলসির রস ব্যবহার করা যেতে পারে। তুলসীর পাতা আদা চা এর সাথে মিশিয়ে পান করলে গলা ব্যাথা দূর হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। তাছাড়া গরম পানি সাথে তুলসির রস মিশিয়ে গড়গড়া কুলি করলে মুখের রোগ জীবাণু দূর হয়ে যাবে।
- ক্যান্সার প্রতিরোধ: ক্যান্সার একটি মরণব্যাধি রোগ। তুলসীর পাতায় বিদ্যমান রয়েছে রেডিওপ্রটেকটিভ উপাদান। এই উপাদানটি টিউমারের কোষগুলোকে মেরে ফেলতে সহায়তা করে। তাছাড়া তুলসী পাতাতে বিদ্যমান রয়েছে মাইরেটিনাল, লিউটিউলিন এবং এপিজেনিন এর মত ফাইটোকেমিক্যাল। এ সকল উপাদান বিদ্যমান থাকার কারণে তুলসীর পাতা ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে থাকে।
- ওজন হ্রাস: তুলসীর পাতা রক্তে চিনির মাত্রা এবং কোলেস্টেরল দুটোই নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ফলে তুলসী পাতা ওজনরা সে সহায়তা করে থাকে। ওবেসিটি ও লিপিড প্রোফাইল নিয়ন্তন করার জন্য ২৫০ মিলিগ্রামের একটি তুলসী পাতার ক্যাপসুল খেলে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করার জরুরী।
- ডায়াবেটিস নিরাময়: তুলসী পাতা অনেক সময় ইনসুলিনের উৎপাদন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেহেতু তুলসী পাতা খেলে রক্তের সুগারের পরিমাণ কমে যায় সেহেতু তুলসী পাতা ডায়াবেটিসের প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে। এজন্য তুলসী পাতা খেলে ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রণে থাকে। তুলসী পাতাতে বিদ্যমান ত্রিতারপিনিন, ফ্ল্যাবোনয়েড ডায়াবেটিস রোধ করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে: তুলসী পাতা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ব্রংকাইটিস, ফুসফুস সহ অ্যাজমার বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় তুলসী পাতার উপকারিতা অপরিসীম। এলাচের পানিতে তুলসী পাতা দিয়ে ফুটিয়ে পান করলে বিভিন্ন রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। যেকোনো ক্ষত জায়গায় তুলসী পাতার রস লাগালে তার দ্রুত শুকিয়ে যায়
তুলসী পাতার অপকারিতা
প্রায় প্রতিটি জিনিসের উপকারিতা ও অপকারিতা উভয়ই বিদ্যমান রয়েছে।
তুলসী পাতার যেমন বহু উপকারিতা রয়েছে, তেমনি ভাবে রয়েছে কিছু অপকারিতা।
আসুন জেনে নেই তুলসী পাতার অপকারিতা সম্পর্কে।
- তুলসী পাতায় বিদ্যমান আইরন ও পারদ এর মাত্রা অত্যন্ত বেশি। এজন্য তুলসী পাতা চাবানোর ফলে দাঁতের ক্ষতি সাধন হতে পারে।
- এস্ট্রাগোল নামের উপাদান তুলসী পাতায় বিদ্যমান থাকার কারণে গর্ভবতী নারীদের জন্য তুলসী পাতা খাওয়া অনুচিত। এর কারণের জরায়ুর শঙ্খচনের ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এটি গর্ভবতী নারীদের জন্য খাওয়া ক্ষতিকর।
- তুলসী পাতা রক্তে চিনির মাত্রা কমায় । এই চিনির মাত্রা কমানো এবং ডায়বেটিকস কমানোর ওষুধ একসঙ্গে সেবন করলে ডায়াবেটিকস কমে নীল হয়ে যেতে পারে। এইজন্য বেশি পরিমাণে তুলসীপাতার সেবন ডায়াবেটিস রোগীদের সব সময় ভালো প্রমাণিত নাও হতে পারে। এজন্য ডায়াবেটিস রোগীদের তুলসী পাতার রস সেবনে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
- তুলসীর রস সেবনের ফলে রক্তের ঘনত্ব ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। এজন্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
- তুলসীতে ক্ষারীয় এসিডিক পদার্থ থাকে যার কারণে তুলসী মুখ মন্ডলের ক্ষতি সাধন করে এবং দাঁতের মধ্যে দাগের সৃষ্টি করে।
রূপচর্চা ও ত্বকের যত্নে তুলসির ব্যবহার
ইতোপূর্বে আমরা জেনেছি তুলসী পাতার সকল ঔষধি গুনাগুন এবং তুলসী
পাতার বৈশিষ্ট্য,উপকারিতা ও অপকারিতা। এখন আমরা জানবো রূপচর্চা ও
ত্বকের যত্নে তুলসী পাতার ব্যবহার সম্পর্কে। তুলসী পাতায় রয়েছে
বিভিন্ন ধরনের উপকারী উপাদান। যেমন: কার্বোহাইড্রেট, সোডিয়াম,
ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ফসফরাস এবং আয়রন সহ আরো
বিভিন্ন ধরনের উপাদান। তাছাড়া তুলসী পাতায় বিদ্যমান রয়েছে
ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে এবং বি৬। এই সকল
কিছু বিদ্যমান থাকার কারণে তুলসী পাতা ত্বকের জন্য প্রচুর উপকারী।
- তুলসী পাতা এন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদানে পরিপূর্ণ। এজন্য ইতি ত্বককে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ থেকে সুরক্ষা করে থাকে এবং ত্বকের ছোপ ছোপ দাগ করতে সাহায্য করে।
- তুলসী পাতার রসের সাথে নিম পাতা কিংবা চন্দন বাটা অথবা গোলাপ জল ব্যবহার করে ফেসপ্যাক তৈরি করে ব্রণের ওপর প্রয়োগ করলে ব্রণ তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।
- বেসন বা ডিমের সাদা অংশের সাথে তুলসীর পাতার মিশ্রণ করে মুখে দিলে, মুখের দাগ দূর হতে সাহায্য করে।
- তেলের সাথে তুলসী পাতার রস মাথায় দিলে খুশকি ও চুলকানি সহ চুলের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া আমলকির গুঁড়ো তুলসী পাতার সাথে মিশিয়ে পানিতে সারারাত রেখে দিয়ে, সেই পানি দিয়ে গোসল করলে মাথার চুল ঝরে পড়া রোধ হয়।
- ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং রূপচর্চা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তুলসী পাতার রসের সাথে গুঁড়ো দুধের মিশ্রণ করে ফেসপ্যাক তৈরি করে নিয়ে ত্বকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- তুলসী পাতার রসের সাথে নিম পাতা বাটা, চন্দনের গুড়া ও গোলাপজল মিশিয়ে ফেসপ্যাক তৈরি করে নিয়মিত মুখে ব্যবহার করলে মুখের ব্রণের সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
- তুলসী পাতা ও টক দই এর সংমিশ্রণে ফেসপ্যাক তৈরি করে ব্যবহারের মাধ্যমে শুষ্ক ত্বকের সমস্যা খুব সহজেই নিরসন করা সম্ভব।
লেখক এর মন্তব্য
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিশেষে বলা যায় যে, তুলসী পাতার সকল
ঔষধি গুনাগুন বিদ্যমান রয়েছে। এবং তুলসী বিভিন্ন উপকারী উপাদান
থাকার ফলে তুলসী পাতার উপকারিতা অপরিসীম। নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিদের
জন্য তুলসী পাতার অপকারিতা বিদ্যমান রয়েছে। সকলের উচিত তুলসীর
বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানা। যেকোন ঔষধি উদ্ভিদ
সম্পর্কে জানতে নিজের কমেন্ট সেকশনে প্রশ্ন করতে পারেন।
মিডপয়েন্ট ওয়েবের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url